সাইমন হার্মারের বলটা কোনোমতে ব্লক করে ড্রেসিংরুমে দৌড় মুশফিকুর রহিমের। দিনের শেষ বল খেলে এমন দৌড় দেখে ধারাভাষ্যকার যেন অবাক, ‘দিন শেষে এমন দৌড়ের পেছনে কী কারণ থাকতে পারে? ক্রিজেও তো এমন ছটফট করছিল!’ শেষ ওভারে টিকে থাকতে অফস্পিনারের বলে তিনবার এগিয়ে আসা… ছটফট নয়তো কী? পোর্ট এলিজাবেথ টেস্টের দ্বিতীয় দিন শেষে মুশফিকের ড্রেসিংরুমে ফেরার তাড়ার কারণ অজানা। তবে বাংলাদেশকে বিপদে ফেলা ৫ ব্যাটসম্যানের সাজঘরে ফেরার তাড়া ছিল প্রায় একই রকম! রানের পাহাড়ে পিষ্ট বাংলাদেশ এই টেস্টে এখন পুরোই ব্যাকফুটে। তাইজুল ইসলামের রেকর্ড গড়া ৬ উইকেটের দিনে দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংস থামে ৪৫৩ রানে। জবাবে বাংলাদেশ দ্বিতীয় দিন শেষ করেছে ৫ উইকেটে ১৩৯ রান নিয়ে।

অতিথিরা এখনও ৩১৪ রানে পিছিয়ে। চোখ রাঙানো ফলোঅন এড়াতে এখনও করতে হবে আরও ১১৫ রান! পারবে তো বাংলাদেশ? অপরাজিত থাকা মুশফিক ও ইয়াসিরের সঙ্গে ক্রিজে নামার অপেক্ষায় থাকা মিরাজ, তাইজুলরা পারবেন কি না, সেটা বিরাট প্রশ্ন। কিন্তু এরকম পরিস্থিতিতে দাঁড় করানোর জন্য সাজঘরে ফেরা পাঁচজনকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোই যায়। প্রোটিয়া বোলাররা আহামরি কোনো বোলিং করেননি। তাতেই এলোমেলো বাংলাদেশ। আগের ম্যাচের সেঞ্চুরিয়ান জয় রানের খাতাই খুলতে পারলেন না। অলিভিয়েরের বল জায়গায় দাঁড়িয়ে খেলতে গিয়ে স্লিপে ক্যাচ দেন। তামিম ও শান্ত দ্বিতীয় উইকেটে প্রতি আক্রমণে দারুণ জবাব দেন।

দুই বাঁহাতির ব্যাটিংয়ে মনে হচ্ছিল, ২২ গজ পুরোপুরি ব্যাটিংবান্ধব। প্রোটিয়া বোলাররা তেমন আগ্রাসী না হওয়ায় বাউন্ডারির ফুলঝুরি ছুটিতে দুজন দ্রুত রান তোলেন। কিন্তু সেখানেই বিপদ ডেকে আনেন তারা। মূল বোলাররা ভালো না করায় এলগার আক্রমণে আনেন মুল্ডারকে। আগের ১০ ম্যাচে ১৫ উইকেট নেওয়া মুল্ডার বল হাতে পেয়ে যেন অন্য রূপে। দুই দিক থেকে সুইং করাচ্ছেন। বাউন্সে বিভ্রান্ত করছেন। চতুর্থ ও পঞ্চম স্ট্যাম্প বরাবর বল রেখে চেপে ধরেছিলেন। ধারাবাহিক বোলিংয়ের পুরস্কার পেয়ে যান এই ডানহাতি পেসার। একটি নয়, দুটি নয়… তিনটি উইকেট পেয়ে যান ছোট্ট ৮ ওভারের স্পেলে। তামিম (৪৭) ও শান্তর (৩৩) পর তার শিকার মুমিনুল (৬)। প্রত্যেককে ফ্রন্ট ফুটে খেলতে বাধ্য করে বল ভেতরে ঢুকিয়ে এলবিডব্লিউ করেন। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের সুইংয়ের দুর্বলতা বুঝে লেট সুইং করিয়েছেন। তাতে মিলে যায় সাফল্য। সাম্প্রতিক ভরসা হয়ে উঠা লিটন যেন তেড়েফুরে খেলতে গিয়ে উইকেট বিলিয়ে দিয়ে এলেন।

অলিভিয়ের বল রিভার্স করিয়ে ভেতরে টানেন। তাতে মনোযোগ হারান লিটন। আলগা শটে উইকেট বিলিয়ে আসেন ১১ রানে। মুশফিক ৩০ রানে ক্রিজে আছেন। কিন্তু একাধিকবার বাজে শটে উইকেট হারাতে পারতেন তিনি। ভাগ্যের জোরেই দিন শেষ করেছেন। ইয়াসির ২০ বলে ৮ রান করে জমাট ব্যাটিং করেছেন। দেখার বিষয় কাল কতটা দৃঢ়চেতা মনোবল দেখাতে পারেন এ ব্যাটসম্যান। তবে, কাজটা যে কঠিন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রথম দিনের মতো শুরুটা হয়েছিল খালেদের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে। তার হাত ধরেই আসে দিনের প্রথম সাফল্য। কাইল ভেরেইনা ও ভিয়ান মুল্ডার স্বাগতিকদের এগিয়ে নিতে থাকেন। খালেদ ইনসুইং ডেলিভারিতে ভেরেইনাকে অবাক করে মিডল স্ট্যাম্প উপড়ে ফেলেন। ৩০০ রানে ষষ্ঠ উইকেট হারানো দক্ষিণ আফ্রিকা সপ্তম উইকেটে ৮০ রানের জুটি পায়। আগ্রাসী ব্যাটিংয়ে দলকে এগিয়ে নেন মহারাজ ও মুল্ডার। মধ্যাহ্ন বিরতির আগে তাইজুল ভাঙেন এ জুটি। দারুণ এক ঘূর্ণিতে ফেরান মুল্ডারকে। কিন্তু বিরতির পর মহারাজকে থামানোর কোনো উত্তর জানা ছিল না কারো। লেজের এই ব্যাটসম্যান উইকেটের চারপাশে ক্রিকেটীয় সব শটে এগিয়ে যান প্রথম সেঞ্চুরির দিকে। কিন্তু বাঁহাতি স্পিনার তাইজুলই থাকে থামান। তার লেন্থ বল স্লগ করতে গিয়ে টাইমিং মিস করে বোল্ড হন ক্যারিয়ার সেরা ৮৪ রান করা মহারাজ। আর এই উইকেট নিয়ে তাইজুল টেস্টে দশমবারের মতো ৫ উইকেট নিলেন। তবে, তার উইকেট ক্ষুধা তখনও বাকি ছিল।

সাইমন হার্মারকে স্ট্যাম্প করে পেয়ে যান ৬ উইকেট। তাতে বেশকিছু রেকর্ডকে সঙ্গী করেন তাইজুল। সাকিবের পর দ্বিতীয় বোলার হিসেবে টেস্টে ১৫০ উইকেটের সীমানা স্পর্শ করেন। তবে, সাকিবের থেকে ৭ ম্যাচ কম খেলে এ রেকর্ডে পা দিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি ১৩৩ বছরের পুরোনো স্টেডিয়ামে প্রথম অতিথি স্পিনার হিসেবে ৬ উইকেট নেওয়ার অনন্য কীর্তি গড়েন তিনি। তাইজুলের হাত ধরেই প্রোটিয়াদের ইনিংসের শেষ হতে পারত। কিন্তু মিরাজ শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে লিজার্ড উইলিয়ামসকে ফেরালে সুযোগটি পাননি তাইজুল। শেষমেশ ৬ উইকেটেই তৃপ্ত থাকতে হয় বাঁহাতি স্পিনারকে। তার কীর্তি, মুগ্ধতা ছড়ানোর দিনে ব্যাটসম্যানরা বাংলাদেশকে কঠিন পরীক্ষায় ফেলেছেন। তৃতীয় দিনে অতিথিদের সামনে কী অপেক্ষা করছে, বলা যাচ্ছে না কোনোভাবেই।